শান্তির খোঁজে মানবজীবন
প্রতিদিন আমরা ছুটে চলেছি — জীবনের লক্ষ্য, সাফল্য, অর্থ, ভালোবাসা কিংবা সুখের সন্ধানে। কিন্তু যখন রাতের নীরবতায় একা হই, তখন হৃদয়ের গভীর থেকে প্রশ্ন আসে — “আমি কি সত্যিই শান্তিতে আছি?”
অধিকাংশ সময় উত্তরটা হয় “না”। কারণ আমরা শান্তি খুঁজি বাইরের জগতে, অথচ ইসলাম আমাদের শেখায় — প্রকৃত শান্তি অন্তরের ভেতরেই, আল্লাহর সাথে সংযোগে লুকিয়ে আছে।
কুরআনে আল্লাহ বলেন —
“জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই অন্তর প্রশান্ত হয়।”
(সূরা রা’দ, আয়াত ২৮)
এই আয়াতটি শুধু ধর্মীয় বক্তব্য নয় — এটি মানুষের মানসিক শান্তির চূড়ান্ত সমাধান।
আল্লাহর স্মরণ (জিকির) – আত্মার ওষুধ
জিকির মানে শুধু আল্লাহর নাম উচ্চারণ নয়, বরং হৃদয় দিয়ে তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে স্মরণ করে আর যে করে না, তাদের উদাহরণ জীবিত ও মৃত মানুষের মতো।” (বুখারী)
দৈনন্দিন জীবনে “সুবহানাল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “আল্লাহু আকবার”, “আস্তাগফিরুল্লাহ” — এই সহজ জিকিরগুলো অন্তরে অপার প্রশান্তি আনে।
সকালে ও রাতে কিছু সময় নির্ধারণ করে নিয়মিত জিকির করলে মনের উদ্বেগ ও ভয় দূর হয়।
নামাজ – মনের প্রশান্তির আশ্রয়
নামাজ শুধু একটি ফরজ ইবাদত নয়, এটি আত্মিক শান্তির দরজা।
প্রতিটি সেজদায় মানুষ নিজের অহংকারকে মাটিতে রেখে দেয়, আর আল্লাহর কাছে প্রশান্তি পায়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:
“নামাজ আমার চোখের শীতলতা।” (আবু দাউদ)
যে ব্যক্তি নিয়মিত নামাজ আদায় করে, সে জানে—
তার দুঃখে একমাত্র আশ্রয় আল্লাহ
তার ভয় কেটে যায়, কারণ সে বিশ্বাস করে আল্লাহ সব জানেন
তার হৃদয় হালকা হয়, কারণ সে নিজের কষ্টগুলো আল্লাহর হাতে সোপর্দ করেছে
তওবা ও ইস্তেগফার – মনের বোঝা হালকা করার পথ
মানুষ ভুল করে, কিন্তু আল্লাহর দরজা কখনো বন্ধ হয় না। তওবা এমন এক শক্তি যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং মানসিক ভারমুক্তি দেয়।
আল্লাহ বলেন:
“হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছ! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয়ই আল্লাহ সব গুনাহ মাফ করেন।” (সূরা যুমার ৩৯:৫৩)
যখন মানুষ আন্তরিকভাবে “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলে, তখন তার ভেতরের অপরাধবোধ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। এটি মনকে শান্ত করে, আত্মাকে নবজীবন দেয়।
কুরআন তিলাওয়াত – আত্মার খাদ্য
কুরআন হলো আল্লাহর বাণী, যা শুধু পড়ার জন্য নয়, বোঝার জন্য নাজিল হয়েছে।
যখন আমরা কুরআন পাঠ করি, তখন হৃদয় আল্লাহর নিকটবর্তী হয় এবং মনের অস্থিরতা দূর হয়।
“আমরা কুরআন নাযিল করেছি চিকিৎসা ও রহমত হিসেবে।” (সূরা ইসরা ১৭:৮২)
প্রতিদিন অল্প হলেও কুরআন পাঠের অভ্যাস করুন।
এর অর্থ বোঝার চেষ্টা করুন।
একটি আয়াতও যদি হৃদয়ে ধারণ করা যায়, সেটিই প্রশান্তির উৎস হতে পারে।
কৃতজ্ঞতা (শুকর) – সন্তুষ্ট জীবনের চাবিকাঠি
আজকের যুগে মানুষ সবসময় যা নেই তা নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু ইসলাম শেখায় —
“যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, আমি অবশ্যই তোমাদের আরও বেশি দিব।” (সূরা ইবরাহিম ১৪:৭)
কৃতজ্ঞ মানুষ সবসময় ইতিবাচক থাকে।
সে যা পায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, তাই তার হৃদয়ে অশান্তি জায়গা পায় না।
প্রতিদিন ঘুমানোর আগে নিজের পাওয়া নি’আমতগুলো গুনে দেখুন — আপনি বুঝবেন, আপনার জীবন বরকতময়।
সৎ সঙ্গ ও ইতিবাচক চিন্তা
ইসলাম শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের শিক্ষা দেয়। তাই এমন বন্ধু নির্বাচন করুন যারা আপনাকে আল্লাহর দিকে ডাকে।
সৎ সঙ্গ মনকে পরিষ্কার করে, আর খারাপ সঙ্গ মনের প্রশান্তি কেড়ে নেয়।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“ভালো বন্ধু মিশকের বিক্রেতার মতো, আর খারাপ বন্ধু কামারের ধোঁয়ার মতো।” (বুখারী ও মুসলিম)
অন্তরের শান্তি আল্লাহর কাছেই
জীবনের দৌড়ে আমরা অনেক কিছু হারাই, কিন্তু আল্লাহর স্মরণে কখনো হারাই না।
শান্তি এমন কিছু নয় যা বাইরে পাওয়া যায় — এটি হৃদয়ের এক অবস্থা, যা আল্লাহর নিকটে যাওয়ার মাধ্যমে অর্জিত হয়।
নিয়মিত নামাজ, জিকির, কুরআন পাঠ, তওবা, কৃতজ্ঞতা এবং সৎ সঙ্গ —
এই ছয়টি অভ্যাসই আপনাকে পৌঁছে দেবে “ইসলামে অন্তরের শান্তির পথে।”




